বড় আকারের রুই জাতীয় মাছ উৎপাদন কৌশল

বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে রাজশাহী এলাকায় বড় আকারের রুই জাতীয় মাছ উৎপাদিত হচ্ছে, যা দেশের বড় বড় শহরের
বাজারসমূহে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের বিভিন্ন উপজেলা বিশেষ করে রাজশাহী জেলার পবা, পুটিয়া,
দূর্গাপুর, মোহনপুর; নাটোর জেলার সিংড়া, গুরুদাশপুর, বড়ায়গ্রাম, লালপুর এবং সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া, তাড়াশ ও
রায়গঞ্জে এ ধরনের বড় আকারের কার্প জাতীয় মাছের মিশ্রচাষ দ্রæত সম্প্রসারিত হচ্ছে। রাজশাহী বিভাগের অন্যান্য অঞ্চলেও স্বল্প
পরিসরে হোলেও এ পদ্ধতিতে মাছচাষ শুরু হয়েছে। উৎপাদিত এ ধরনের বৃহৎ আকারের (৪-২০ কেজি) মাছ জীবন্ত অবস্থায়
রাজধানি ঢাকার বজারসহ দেশের অন্যান্য বৃহৎ শহরগুলোতে পৌছে যাচ্ছে। বড় আকারের মাছের চাহিদা সারা বছরই একই রকম
থাকে এবং এর বাজার মূল্যও খুব বেশি উঠা নামা করে না। ফলে প্রতি দিন ২০০-২৫০ ট্রাক মাছ যমুনা সেতু পার হয়ে দেশের
ভিবিন্ন শহরে পৌছে যাচ্ছে। বড় আকারের মাছ উৎপাদনের এ কৌশল এ অঞ্চলে মাছচাষে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে।
পুকুরে কার্পজাতীয় মাছের মিশ্রচাষের এ বিশেষ পদ্ধতিটি এলাকা ভিত্তিক নানা মাত্রায় নানাভাবে প্রয়োগ হচ্ছে এবং চাষ পদ্ধতিতে
কিছু ভুল ভ্রান্তিও চর্চার মধ্যে প্রবেশ করেছে বলে আমাদের প্রতিয়মান হয়। এ পদ্ধতিতে মাছচাষ সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে বিদ্যমান
তথ্যগত ঘাটতি পুরণসহ একটি সমন্বিত ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য এবং সঠিক ধারণা সকলের কাছে পৌছে দেবার জন্য আমাদের
আজকের এ প্রচেস্টা। আশা করি নতুন আগ্রহী মাছচাষি এবং মাঠ পর্যায়ে কর্মরত সম্প্রসারণ কর্মীরা বড় আকারের রুই জাতীয়
মাছের উৎপাদন কৌশলের বিষয়ে সঠিক ধারণা লাভ করতে পারবেন।

কার্প মিশ্রচাষ
বিভিন্ন প্রজাতির কার্প জাতীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ (Indian Major Carp & Chinese Carp) একয় পুকুরে একত্রে প্রাকৃতিক ও সম্পূরক খাবার ব্যবহারকরে যে চাষ করা হয় তাহাই কার্প মিশ্রচাষ হিসাবে পরিচিত। এ পদ্ধতিতে যখন বড় আকারের (০২ কেজি হতে ১০ কেজি বা এর চেয়েও বড়) মাছ উৎপাদন করা হয় তখন অনেকে এ পদ্ধতিকে কার্প মোট-তাজাকরণ বা কার্প ফ্যাটেনিং বলে থাকেন। রাজশাহী অঞ্চলে উৎপাদিত এ বড় আকারের মাছ সারাদেশে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। বড় আকারের এ মাছ বেশি পরিমাণে উৎপাদন করলেও বিক্রয় করতে কোন সমস্যা হয় না। কার্পজাতীয় মিশ্রচাষের সাথে সাথি ফসল হিসেবে প্রচুর পরিমাণে ফলি ও চিতল মাছও উৎপাদিত হয়। বর্তমানে অনেকেই এ মাছের সাথে একত্রে শিং-মাগুর, পাবদা, গুলশা ও ট্যাংরা চাষ শুরু করে অধিক লাভ নিশ্চিত করছেন।

কার্প জাতীয় মাছের মিশ্রচাষের সুবিধা
১) স্তর ভিত্তিক পোনামাছ মজুদের ফলে পুকুরের সকল স্তরের খাদ্য সর্বোত্তম ব্যবহার করা যায়;
২) সিলভার কার্প মজুদের মাধ্যমে ফাইটোপ্লাংটনের প্রাচুর্যতা (অ্যালগাল বøুম) নিয়ন্ত্রণ করা যায়;
৩) গ্রাসকার্প জলজ উদ্ভিদ (তন্তুজাতীয়) নিয়ন্ত্রণ করে পাশাপাশি এ মাছের মল কার্পের খাদ্য ও সার হিসেবে ব্যবহৃত হয়;
৪) তলবাসী মাছ মৃগেল, কমনকার্প, মিরর কার্প কাদায় খাদ্য খোঁজে খায় এর ফলে তলদেশের পুষ্টি পানিতে মিশ্রিত হয়, তলদেশের গ্যাস দূর করে এবং
৫) পুকুরের শামুক নিয়ন্ত্রণে বøাককার্প মজুদ করা হয় এবং
৬) একয় সাথে বেশ কয়েক প্রজাতির মাছ এক সাথে চাষ করার ফলে পুকুরে সর্বোত্তম উৎপাদন পাওয়া যায়।

মাছচাষ ব্যাবিস্থাপনা
মাছচাষের জন্য পুকুর নির্বাচন থেকে শুরু করে মাছ বাজারে বিক্রয় পর্যন্তধারাবাহিকভাবে কিছু কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হয় যার
সমস্টিকে এক কথায় মাছচাষ (Aquaculture) বলে। এসকল কার্যক্রমকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায় ক) মজুদ পূর্ব ব্যবস্থাপ
না খ) মজুদ কালিন ব্যবস্থাপনা এবং গ) মজুদ পরবর্তি ব্যবস্থাপনা

ক) মজুদ পূর্ব ব্যবস্থাপনা
পুকুর নির্বাচন ঃ যে কান পুকুরে এ ধরনের মাছচাষ করা সম্ভব নয়। যেহেতু বড় আকারের মাছ উৎপাদন করা হয় সে জন্য বড় আকারের (২-১০ একর) গভীর (৫-১০ ফুট) পুকুরের প্রয়োজন। বণ্যা মুক্ত মজবুত পাড়যুক্ত রৌদ্রউজ্জল পুকুর এপদ্ধতিতে মাছচাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে। মাছচাষের উপকরণ ও মাছ সহজে পরিবহনের জন্য পুকুরটির যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল হতে হবে।

১) পুকুর প্রস্তুতি ঃ ডিসেম্বর ও জানুয়ারী মাসে পুকুর প্রস্তুতি শুরু করতে হয়। আগের অধ্যায়ে আলোচিত পদ্ধতিতে নির্বাচিত
পুকুরটি মাছাচাষের উপযোগী করার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। তবে সব সময় একয়ভাবে প্রস্তুত করা যায় না কারণ এখানে বড়
আকারের পুকর ব্যবহারকরা হয় যা স্বেচ দিয়ে তৈরি করা যায় না বা সব সময় শুকানো যায় না। ফলে মাছচাষ চলাকালে বিশেষ
কিছু সমস্যার সম্মূখিন হতে হয় তা প্রতিরোধের জন্য নানা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হয়।

২) মজুদের জন্য পোনা নির্বাচন ঃ এ পদ্ধতিতে মাছচাষের জন্য রুই জাতীয মাছের নুন্যতম ২৫০ গ্রাম থেকে ২ কেজি আকারের
মাছে প্রয়োজন হয় অনেক সময় এর চেয়েও বড় পোনা পুকুরে মজুদ করা হয় অধিকতর বড় আকারের মাছ উৎপাদনের জন্য। এ
পদ্ধতিতে সাধারণত রুই ও কাতল মাছের পোনা তুলনামূলক বেশি লাগে। বাজারসমূহে রুই ও কাতল মাছের চাহিদাও বেশি
দামও বেশি এ জন্য মাছচাষিরা এ পদ্ধতিতে রুই-কাতল মাছ যাতে বেশি চাষ করতে পারেন সে জন্য বিশেষ যতœবান থাকেন। এ
পদ্ধতিতে সাধারণত তলদেশের মাছ (মৃগেল, কার্পিও, কালিবাউশ) তুলনামূলক কম চাষ করা হয় যা সাধারণ রুই জাতীয মাছের
মিশ্রচাষের অনেকটা বিপরিত। এ মিশ্রচাষ পদ্ধতি ব্যবহৃত পোনা অবশ্যই ভাল মানের হতে হবে।


৩) পোনা সংগ্রহ ঃ এপদ্ধতির চাষে ব্যবস্থাপনায় যেহেতু বড় আকারের পোনা লাগে এ জন্য পোনা সংগ্রহে খরচ বেশি। বিশেষ
করে বড়পুকুরে চাষ করা হয় বলে পোনার পরিমাণও বেশি লাগে। বড় আকারের মাছ উৎপাদন করা হয় বলে পোনার গুণগত মান
অবশ্যই ভাল হতে হবে। অন্যথায় ভাল ফলাফল পাওয়া যায় না। এজন্য পোনা সংগ্রহে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
যদি সম্ভব হয় প্রাকৃতিক উৎসের পোনা সংগ্রহ করে নিজের পুকুরে চাষ করে উপযুক্ত আকারের পোনা তৈরি করে নিতে হবে। যদি
প্রাকৃতিক উৎসের পোনা না পাওয়া যায় তা হলে অবশ্যই ভাল মানের হ্যাচারি বা উৎস হতে পোনা সংগ্রহ করতে হবে। রাজশাহী
অঞ্চলে অবশ্য এক ধরনের চাষি গড়ে উঠেছে যারা কেবল এ ধরনের পোনা উৎপাদন করে বড় খামারীদের নিকট বিক্রয় করেন।
অবশ্য অভিজ্ঞ চাষিরা নিজের চাহিদা মত পোনা নিজের পুকুরে উৎপাদন ও মজুদ রাখেন। অনেক সময় আংশিক আহরণের পর
পোনা পুনরায় মজুদ করা হয় সে জন্য প্রয়োজনীয় পোনা প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য নিজের পুকুরে পোনা মজুদ রাখাটায় উত্তম।

Ali H Shawon
4

Всего комментариев: 1

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *